রিভিউঃ আমার প্রিয় ছবি পথের পাঁচালী - কাইয়ুম চৌধুরী

সত্যজিৎ রায়ের অমর সিনেমা পথের পাঁচালী প্রথম দেখার অভিজ্ঞতা এবং সিনেমাটি সমন্ধে তাঁর উপলব্ধি বণর্না করেছেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী।


অপু, দুর্গা, ও সর্বজয়া - পথের পাঁচালী<
অপু, দুর্গা, ও সর্বজয়া - পথের পাঁচালী
খুব সম্ভব ১৯৫৫ সালে পথের পাঁচালী প্রথম দেখি গুলিস্তান সিনেমা হলে। বাণিজ্যিক মুক্তি ছিল না ছবিটির। ভারতীয় হাইকমিশনের সৌজন্যে বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। অনেক গুণীজন সমভিব্যহারে ছবিটি দেখেছিলাম। দেখেছিলাম বলাটা বোধহয় ভুল হবে। কিছুই দেখিনি। পুরো ছবিটি প্রদর্শনকালে চোখ দুটি অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে যাচ্ছিল বারবার। চোখ মুছছিলাম, আর ঝাপসা চোখে পর্দার দিকে তাকাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল, নিজের জীবনকে দেখছি, নিজেকে দেখছি। আমিই যেন নিশ্চিন্দিপুরের সেই অপু। বাংলা চলচ্চিত্রকে জীবনের অংশ বলেই সেই প্রথম মনে হয়েছিল। এরপর ছবিটি ১৫-১৬ বার দেখেছি। যতবার দেখেছি, ততবারই ছবির নতুন নতুন দিক আমার কাছে উন্মোচিত হয়েছে। চলচ্চিত্রের বিভিন্ন আঙ্গিক আমার বোধকে শাণিত করেছে। চলচ্চিত্রের ভাষাকে হূদয়ঙ্গম করেছি, বুঝতে শিখেছি। এখনো যখন সুযোগ পাই পথের পাঁচালী দেখার, দেখি—হঠাৎ নতুন অর্থ আবিষ্কৃত হয়—চোখে মুগ্ধ বিস্ময়। যদিও জানতাম, সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি পথের পাঁচালী।

দুর্গা ও ইন্দির ঠাকরুন - পথের পাঁচালী
দুর্গা ও ইন্দির ঠাকরুন
বিস্ময় চোখে অপু - পথের পাঁচালী
বিস্ময় চোখে অপু
কৈশোরে ‘আম আঁটির ভেঁপু’ পড়েছিলাম গোগ্রাসে। পথের পাঁচালীর কিশোর সংস্করণ। বইয়ের রঙিন প্রচ্ছদ, ভেতরের সাদা-কালো ছবি টেনেছিল মূল বইটি পড়তে। তখনো পড়তে পড়তে চোখ ঝাপসা হতো। ছবির মতো একটানা নয় যদিও। ছবি দেখার পর মনে হলো, ‘আম আঁটির ভেঁপু’-ই হলো পথের পাঁচালীর সত্যজিতের করা চিত্রনাট্য, যা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখে গেছেন। সবচেয়ে বিস্ময়ের, ‘আম আঁটির ভেপু’র ইলাস্ট্রেশন পথের পাঁচালী ছবির এক একটি ফ্রেম। ‘আম আঁটির ভেঁপু’তে ছুটে চলা অপু দুর্গার ছবি পথের পাঁচালী ছবির লোগো হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে। যখন সত্যজিৎ ছবি তৈরি করার কথা ভাবেননি, লন্ডনে যাচ্ছেন ডি জে কিমারের হেড অফিসে, গ্রাফিক ডিজাইনে উন্নততর প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য; জাহাজে বসে সিগনেট প্রেসের দিলীপ কুমার গুপ্তের নির্দেশে ‘আম আঁটির ভেঁপু’র প্রচ্ছদ ও ইলাস্ট্রেশনের জন্য পড়ছেন পাণ্ডুলিপি। মুগ্ধ বিস্ময় ছবি তৈরির চিন্তা তখন মাথায়। ছবি দেখতেন প্রচুর। হলিউডি ছবির একনিষ্ঠ ভক্ত—চিত্রনাট্যের খসড়াও ইলাস্ট্রেশনের সঙ্গে সঙ্গে তৈরি।

পরতে পরতে ছবির মুগ্ধ বিস্ময়ের দিকগুলো আমার কাছে উন্মোচিত হয়েছে প্রতি দর্শনে। পুঁথির হরফে লেখা ছবির টাইটেল মনে করিয়ে দিল, ছবির নায়ক হরিহর পুঁথি লেখেন। কথকতা তাঁর পেশা। ছবির আবহ তখনই তৈরি হয়ে যায়, যখন পশ্চাত্পটে রবিশংকরের অসাধারণ সংগীত সেতারে করুণ আবহ তৈরি করে দেয়। সত্যজিৎ কখনো গ্রাম দেখেননি। শান্তিনিকেতনই তাঁর দেখা গ্রাম। সত্যজিতের চোখে সুব্রত মিত্রের ক্যামেরায় বাংলা কী প্রাণবন্ত, সজীব। এখনো একটি দৃশ্য চোখে ভাসে, চাদর মুড়ি দিয়ে অপুর তেলের বোতল হাতে, ছাতা বগলে মেঘমেদুর আকাশের গুড়গুড় শব্দে গ্রামের পথে ঈষৎ হাওয়ায় হেঁটে যাওয়া—বর্ষার আগমনের কী সুন্দর চিত্রায়ণ। বর্ষা নেমেছে, অপু-দুর্গার বৃষ্টিতে ভিজে আম কুড়ানো আমাদের শৈশবের কথাই মনে করিয়ে দেয়। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে কাশবনে অপু-দুর্গার ছোটাছুটির—টেলিগ্রাফের খুঁটিতে শব্দ শোনা, দূরে ঝিকঝিক আওয়াজ—সাদা কাশবনের পশ্চাত্পটে কালো ধোঁয়া ছেড়ে ট্রেনের আগমন—গ্রামীণ জীবনের মাঝে আধুনিকতার আভাস—ট্রেনের এপাশ থেকে ওপাশে অপুর বিস্ময়ভরা চোখ—এ রকম অজস্র চিত্রকল্প ছবিতে ছড়িয়ে আছে। সাদা-কালোর সুষম ব্যবহার একটি অবাক বিস্ময়। এ রকম অজস্র উপমার মাঝে বর্ষার আগমনের চিত্র—মাছ ধরারত টেকোর মাথায় বৃষ্টির ফোঁটা, পদ্মপাতায় জল ফড়িংয়ের নাচ, বাতাসে পদ্মপাতার কম্পন অভাবনীয় দ্যোতনার জন্ম দেয়। সবচেয়ে হৃদয় নিংড়ানো যে উপমাটি সত্যজিৎ উপস্থাপন করেছেন, সেটি কাশী যাওয়ার আগে গোছগাছ করার মুহূর্তে অপুর তত্ত্ব তল্লাশিতে তাদের ওপর দুর্গার একান্ত সংগ্রহের ঝাঁপিতে চুরি করা গলার মালার আবিষ্কার—যেটাতে দুর্গার অস্বীকৃতি মূঢ় করে দেয় অপুকে—ছুড়ে ফেলে পুকুরের পানায়, মালার আঘাতে পানা সরে যায় বৃত্তাকারে, আবার বুজে যায়—বিস্মৃতির অতলে ডুবে যায় দুর্গা। একটি অবিস্মরণীয় চিত্রকল্প, যা আজও হূদয়তন্ত্রীতে আঘাত হানে। এ রকম অজস্র চিত্রকল্প ছড়িয়ে আছে পথের পাঁচালীর প্রতিটি ফ্রেমে। যতবার ছবিটি দেখব, নতুন নতুন আবিষ্কারে অভিভূত হব।

অসুস্থ দুর্গা ও অপু - পথের পাঁচালী
অসুস্থ দুর্গা ও অপু

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে, ফরাসি চিত্র পরিচালক জাঁ রেনোয়ার উপস্থিতি সত্যজিতের জীবনে। দ্য রিভার পরিচালনার সূত্রে রেনোয়া এসেছিলেন কলকাতায়। সত্যজিৎ তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন অকৃপণ। যদিও রুমার গডেনের উপন্যাস দ্য রিভার-এর পশ্চাত্পট নারায়ণগঞ্জের পাটকল-সমৃদ্ধ এ অঞ্চল। চলচ্চিত্র নির্মাণের সুযোগ-সুবিধা এবং স্থানীয় চলচ্চিত্র নির্মাণের অবকাঠামো তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে না থাকায় কলকাতাকেই জাঁ রেনোয়া বেছে নেন তাঁর লোকেশন হিসেবে। এ সুযোগ পুরোপুরি গ্রহণ করেন সত্যজিৎ। যদিও পথের পাঁচালীর শিল্পনির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন একমাত্র, যিনি দ্য রিভার ছবিতে কাজ করেছিলেন। পথের পাঁচালীর ইউনিটে অন্য কারও চলচ্চিত্রে কাজ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। আমি অত্যন্ত বিস্ময়াভিভূত পথের পাঁচালীর প্রত্যেক শিল্পীর অভিনয় প্রতিভার উত্কর্ষ সম্পর্কে—এক কথায় অনবদ্য। এটা সত্যজিতের পক্ষেই বোধহয় সম্ভব ছিল তাঁর পারিবারিক পরিচিতিতে। ইন্দির ঠাকরুনের চরিত্রে চুনীবালা দেবীর পুনরাবির্ভাব বোধহয় সত্যজিতের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। সর্বজয়ার চরিত্রে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় একমেবাদ্বিতীয়ম। কল্পনাই করতে পারি না অন্য কাউকে এই নন্দিত চরিত্রে। নাটকে অভিনয় ছাড়া করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি দেখেছি ঢাকায়, যখন তাঁর স্বামী সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয় হাইকমিশনে প্রথম সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন। করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন আমাদের চারুকলা ইনস্টিটিউটে মৃৎশিল্প বিভাগে খণ্ডকালীন ছাত্রী হিসেবে ছিলেন। মৃদুভাষী, সংস্কৃতিমনা করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তখন দেখেছি, আলাপও হয়েছে অভিনয় সম্পর্কে; বিশেষ করে, পথের পাঁচালী নিয়ে। সব কিছুর ঊর্ধ্বে তিনি এ সাফল্যের কাণ্ডারি হিসেবে তাঁর মানিকদা অর্থাৎ সত্যজিতকেই সামনে টেনে এনেছেন।

কান ফিল্ম ফেস্টিভালে ‘দি বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্টস অব দি ইয়ার’ পুরস্কারে ভূষিত বাঙালিদের কাছে পথের পাঁচালী বাঙালি জীবনের একটি অনবদ্য চিত্র হিসেবেই বিবেচিত হবে। অর্ধশত বছর আগে নির্মিত সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী আমার অন্যতম প্রিয় ছবি এবং এখনো সুযোগ পেলে ছবিটি আমি উপভোগ করি; সেই সঙ্গে পরবর্তী দুটি—অপরাজিত, অপুর সংসারসহ। অপুত্রয়ী আমার প্রিয় ছবির তালিকায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

১৬ জানুয়ারী, ২০১০
Related Posts with Thumbnails