রিভিউঃ ঋত্বিক ঘটকের - নাগরিক

১৯৫৩ সালে নির্মিত ঋত্বিক ঘটকের 'নাগরিক' সিনেমাটি তৈরি ও মুক্তির ইতিহাস, এবং সিনেমাটিতে প্রদর্শিত জীবনবোধ নিয়ে লিখেছেন দ্বীপান্বিতা


"এইভাবে,
পৃথিবীর ইতিহাস বারবার
বদলে গেছে।
তবুও মানুষ, সবসময় বেঁচেছে,

আমরা পাগলের মতো জীবন
চালিয়ে গেছি,
কিন্তু এটাই জীবন।"

[ “আমাদের ফেলো না” - ঋত্বিক ঘটক , সাহিত্যপত্র ১৩৭৫ সাল (বাংলা)(ইং- ১৯৬৮)]

ইতিহাস বদলের সময় মানুষের বাঁচার লড়াই -এর গল্প এই “নাগরিক”। এক নাগরিকের বেঁচে থাকার পাগলামোই এই চলচ্চিত্রের মূল বিষয়।

এই চলচ্চিত্রটি ১৯৫৩ সাল নাগাদ মুক্তিলাভের জন্য প্রস্তুত হয়েও একটি বিশেষ বানিজ্যিক জটিলতার কারণে অবশেষে এর মুক্তিলাভ সম্ভব হয়ে ওঠেনি। দীর্ঘদিন পরে থাকার ফলে এর Negetive টিও হারিয়ে যায়। শেষে প্রায় ২৪ বছর পর অতি খারাপ একটি print থেকে ডিউপ Negetive বার করে সেখান থেকে print করান হয় এবং ১৯৭৭ -এর শেষ দিকে “নাগরিক” মুক্তিলাভে সক্ষম হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এর মুক্তিলাভ ঋত্বিক ঘটকের আর দেখা হয়ে ওঠেনি। তিনি তার আগেই মারা যান।

ছবিটি ওই খারাপ print থেকে উদ্ধারের ফলে ছাবিটির আলো-ছায়ার বৈপরিত্য ১৬ আনাই চলে যায়। সে সময় sound track এবং মেকআপ সেরকম উন্নত না থাকায় নতুন print টিতে তার অবস্থা আরও খারাপ হয়। স্বাভাবিক ভাবেই চলচ্চিত্র শিল্পে আলো-ছায়া থেকে যে চলচ্চিত্র ভাষার স্থান তৈরী হয় সেটি এই print টিতে প্রায় খুঁজেই পাওয়া যায় না। ছবিটিতে camera movement এবং সম্পাদনা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। কিছু অংশে সম্পাদনার যে স্বাভাবিক ছন্দ থাকে সেটিও অনেকটা হারিয়েছে। এই সবকিছু হারিয়েও “নাগরিক” কে বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পে নব-তরঙ্গের (new wave cinema) সূচনা ধরা যেতে পারে। এটা একটা বড় প্রাপ্তি।

ঋত্বিক ঘটকের কথায় “দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর বাংলার মধ্যবিত্তের জীবন- যন্ত্রনার এটিই প্রথম বস্তুনিষ্ঠ শিল্পরূপ”। এটি একটি বাস্তববাদী চলচ্চিত্র। ১৯৫০-৫১ - এ চিত্রনাট্য রচনাকাল হলেও আজও এর যর্থাথতা আছে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর কলকাতা শহরের মধ্যবিত্তদের প্রতিনিধি হিসাবে এক নাগারিককে বেছে নেওয়া হয়েছে এই চলচ্চিত্রে। এই নাগরিকের নাম রামু। সে রোজ interview দিতে যায়। কিন্তু বিফল হয় বার বার, তবু আশা ছাড়ে না। রোজ সে স্বপ্ন দেখে, একটু ভালো থাকার, একটু নিশ্চিন্ততার।

এই নাগারিককে কেন্দ্র করে আর যে সব চরিত্র আছে (যেমন বা,মা,বোন,পেইংগেস্ট,প্রেমিকা ইত্যাদি) তারা কেউ অবসাদগ্রস্ত, কেউ উদাসীন, কেউ বাঁচার সহজ উপায় খুঁজতে গিয়ে হয়তো সবচেয়ে সস্তা উপায় খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু সবার উদ্দেশ্য একটু বাঁচা, একটু নিশ্চিন্ততা।

রামু প্রতিনিয়ত লড়াই করে চলে। কখনো ভেঙ্গে পড়ে, কখনো নতুন করে আশায় বুক বেঁধে আবার নতুন উদ্দ্যমে লড়াই করে। কিন্তু প্রতিবার বিফলতা আসার ফলেও রামুর আত্মভিমান একটুও কমে না। মানুষ রামুর পরির্বতন হয় না।

এই কাহিনীতে আমাদের বেঁচে থাকার অন্যান্য চাহিদাও দেখান হয়েছে। যেমন রামু উমাকে ভালোবাসে কিন্তু প্রতিদিনের অসফলতা তাকে ভীরু, কাপুরুষ করে তুলেছে। সে কারণে রামু তার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চায়। এখানে ভগ্ন সমাজ ব্যাবস্থার রূপটাও খুব পরিস্কার দেখান হয়েছে। যেমন স্বজনপোষন নীতি, আর্থসামাজিক অবস্থার ভগ্নরূপ ইত্যাদি। এক কথায় সামাজিক অবক্ষয়ের দিকটা পরিস্কার দেখান হয়েছে। এখানে বাঁচার সমবেত লড়াইকে গন আন্দোলন রূপে তুলে ধরা হয়েছে।


এই কাহিনীর শেষপ্রান্তে এসে রামু অনুভব করেছে, তার এই লড়াইতে আর্থিক পরিকাঠামোতে আমূল পরির্বতন কিংবা তার রোজকার দেখা স্বপ্ন বাস্তবায়িত করা কোনটাই সম্ভব নয়। এই কঠোর বাস্তবটা রামু তার নাতিদীর্ঘ লড়াইয়ের পথেই অনুধাবন করে। অভিজ্ঞতা তাকে মানসিক ভাবে বলিষ্ঠ করে তোলে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, আর স্বপ্ন নয়, এবার খালি লড়াই। তার এই লড়াইতে সে উমাকেও সামিল করতে চায়। ঠিক করে নেয় উমাকে সে বিয়ে করে নেবে।

শেষ দৃশ্যে রামু যখন বাসাটি (ভাড়া বাড়ি) ছেড়ে আরও নিম্নমানের বাসাতে যাবার ব্যাবস্থা করে সেই মুহূর্তে অপর আরেকটি পরিবার নিশ্চিন্ততার স্বপ্ন নিয়ে,ভালোভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন নিয়ে রামুদের ছেড়ে দেওয়া বাসাতে প্রবেশ করে। এই ভাবে ঘটনার নতুন আবর্তের সূচনা করে চিত্রনাট্যটি শেষ হয়।

কাহিনীর মধ্যে একটা আশার আলো লুকিয়ে আছে, যেটা প্রত্যেক নাগারিককে লড়াই করার উদ্যম যুগিয়ে যায়। কাহিনীর চরিত্র বিন্যাসের মধ্যে বেহালা বাদক চরিত্রটি এবং তার চলচ্চিত্রায়ন চলচ্চিত্রটিতে আতিরিক্ত মাত্রা যোগ করেছে। জীবনযোদ্ধার স্বপ্নের ছন্দপতনের রূপক হিসাবে বেহালার তার ছিড়ে যাওয়ার দৃশ্যটি অসাধারণ।

(ধন্যবাদ world film note)

রিভিউটি লিখেছেনঃ দ্বীপান্বিতা
সিনেমার লিংক

0 টি মন্তব্য:

Post a Comment

এই সিনেমা/গান/রিভিউটি কেমন লাগলো?

Related Posts with Thumbnails